Skip to content
Mahmudul Hasan

মেঘ ও নোনা পানির শহরে (প্রথম পর্ব) – চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গপ্প

Travel, Personal8 min read

A journey to the city of cloud and salt water

"সারাদিন অনেক ক্লান্ত ছিলাম। বাসে উঠার পর কম্বল গায়ে দিয়ে একটু চোখ বুজলাম। চোখ খুলে দেখি চিটাগাং পৌঁছে গেছি। দেড় ঘন্টায় কিভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছলাম তা মাথায় আসছিল না।"

সাধারনত প্রতি ঈদে নতুন কোন স্থানে ভ্রমনে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকি। গত কয়েক ঈদে এক দিনের ছোট ট্যুর দেয়া হয়েছে । কিন্তু এবার রোজার আগে থেকেই প্ল্যান ছিল লম্বা কোন ট্যুর দেবার। প্রথমে সিলেট ঠিক হলেও পরে কক্সবাজারই হল আমাদের এবারের ঈদ পরবর্তী গন্তব্য। পথে যেহেতু চন্দ্রনাথ পাহাড় পরে, তাই লিস্টে তাও যোগ হয়ে গেল।

মূলত আমার জোড়াজুরিতেই সবাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যেতে রাজি হয়। এই পাহাড়ে উঠার জন্য আমার বিশেষ ইচ্ছা ছিল। কেননা গতবছর আমি যখন চিটাগাং যাই, তখন বেশ কিছু স্থান পরিদর্শন করলেও চন্দ্রনাথ পাহাড় ছাড়া পরে গেছিল, কিন্তু আমার কিছু বন্ধু ঠিকই দর্শন করেছিল। এটাকে একপ্রকার জেলাসি বলতে পারেন। হা হা হা।

যাহোক, বড় ভাই শামিম অনেক গবেষণা করে যাওয়ার দিন তারিখ ৯ ই জুন ঠিক করল যেন সবার সময়ে অনুকূল হয়। আর ট্রেন জার্নি সবারই প্রিয়, তাই বাই ডিফল্ট ট্রেনে যাওয়া হবে তা ঠিক হয়ে গেল।

যাত্রীর সংখ্যা ৫ জন। আমি, বড় ভাই ইমন, শামিম, বন্ধু জীবন ও আব্দুল বাকী। সময় তিন দিন দুই রাত।

রুট প্ল্যান

রাজশাহী – ঢাকা – সিতাকুন্ড – চন্দ্রনাথ পাহাড় – সহস্র ধারা ও সুপ্ত ধারা ঝর্ণা – খইয়াছড়ি ঝর্ণা – কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, মেরিন ড্রাইভ ও হিমছড়ি ঝর্ণা – চট্টগ্রাম – ঢাকা – রাজশাহী

আবহাওয়া বিড়ম্বনা

৯ তারিখের ট্রেনের টিকিট অগ্রিম অনলাইনে ১ তারিখে কাটার সিধান্ত ছিল কেননা ঈদের সময়ে একটি টিকিট যেন সোনার হরিণের চেয়েও বেশী কিছু। টিকিট কাটলেই যে ট্যুরের একধাপ এগিয়ে যাওয়া, তাই যতই ১ তারিখ নিকটে আসে ততই উত্তেজনা বাড়ে। কিন্তু বাধ সাধল ওয়েদার ফোরকাস্ট। ফোরকাস্টে দেখানো হল যে ৪ তারিখ থেকে ১২ তারিখ প্রবল ঝড় আর বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

এই ছোট্ট সংবাদই আমাদের যাওয়া দোটানায় ফেলে দিল। আমরা ভাবলাম এই প্রতিকূল পরিবেশে যাওয়াটা বোকামিই হবে। তাই টিকিট আর কাটা হল না। তার সাথে সিট পাওয়ার আশাও শুন্য হয়ে গেল।

কিন্তু আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ছিল বলেই ৯ তারিখ ঝকঝকা সুন্দর এক রৌদ্রজ্বল দিনে আমরা বেড়িয়ে পরলাম। ট্রেনের সময় দুপুর ৪ টা। একটু আগেভাগেই স্টেশনে গিয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকার স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটে ফেললাম। ভাড়া ৩৫০ টাকা।

নতুন অভিজ্ঞতা

Mahmudul Hasan on the roof of a train for the first time.
ট্রেনের ছাদে প্রথমবার

টিকিট তো কাটলাম, কিন্তু সিট নেই। উপরন্তু ঈদের উপচে পরা ভিড়। এখন কি করি?

কেননা দাঁড়িয়ে যদি রাজশাহী থেকে ঢাকা যাই, তাহলে অনেক ক্লান্ত হয়ে যাব, তাছাড়া আমাদের গন্তব্য ঢাকা ছেড়ে আরও বহু দূর। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত।

ট্রেনে যখন যাত্রী উঠা শুরু করল, তখন দেখে মনে হল সিট তো দূরের কথা, দাঁড়ানো যাবে কি না সন্দেহ। সহযাত্রী জীবন বলল “চল, সবাই ট্রেনের ছাদে যাই। তাহলে বসে যাওয়া যাবে”। আমি প্রথমে না করলেও সবাই ছাদে উঠে পরল। তাহলে আমি আর বাকি থাকি কেন। ছাদে উঠে সুবিধা মত স্থানে বসে পরলাম।

ট্রেনের ছাদে যাওয়ার আমার নতুন অভিজ্ঞতা। ট্রেন যখন থেমে থাকে, তখন গরম লাগলেও চলা শুরু করলে প্রচন্ড বাতাস। আমার আবার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। প্রচন্ড বেগের বাতাস মাথায় সরাসরি লাগার কারণে কিছুদূর যেতেই মাথা যন্ত্রণা শুরু হল। একটা টলফেনামিক এসিট সমৃদ্ধ ঔষধ খেয়ে বন্ধু আব্দুল বাকীর দেখা দেখি মাথা ও মুখে নেকাবের মত করে গামছা পেঁচিয়ে নিলাম।

ছাদে আমাদের বগিতে তেমন কোন ভীর ছিল না। প্রথমে সিট নিয়ে সন্দেহ থাকলেও পুরো রাস্তা শুয়ে বসে আরামে চলে গেলাম। নেই কোন গরম, ধাক্কা ধাক্কি বা হকারদের কোলাহল।

স্কেজুয়েল বিপর্যয়

রাজশাহী থেকে ট্রেন ছেড়েছিল প্রায় এক ঘন্টা দেরীতে বিকাল ৫.১০ এ। আর উটকো ঝামেলা হিসেবে সাথে যোগ হল ক্রসিং। উল্লাপাড়া স্টেশনের পর থেকে একের পর এক ক্রসিং পড়তে লাগল। শুধু মাত্র যমুনা সেতুর শুরুতেই ট্রেন থেমে ছিল এক ঘন্টা বিশ মিনিট। আমাদের প্ল্যান ছিল ঢাকা গিয়ে চট্টগ্রাম গামী রাতের ট্রেন ধরব। সে আশা যতই সময় গড়াতে লাগল, ততই ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল।

ট্রেন ঢাকা পৌঁছল মোটামুটি রাত একটা বিশে। দুঃখের কথা হল টঙ্গী জংশনে আমরা চট্টগ্রাম গামী শেষ ট্রেইন চলে যেতে দেখলাম। যদিও তখন আমরা জানতাম না যে অইটাই শেষ ট্রেইন।

টিকেট কমলাপুর স্টেশনে যাওয়ার অনুমতি দিলেও আমরা নেমে পরলাম বিমানবন্দর স্টেশনে যেন কমলাপুর থেকে ট্রেন বিমানবন্দরে আসার মাঝে আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারি। অথবা যদি ট্রেইন ছেড়ে দেয়, তাহলে ধরতে সুবিধা হবে।

হতাশ হয়ে গেলাম টিকেট কাটতে গিয়ে। টিকেট বিক্রেতা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাল যে রাতে আর ট্রেইন নেই, সব ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। আমরা পরে গেলাম সঙ্কটে। যদি সকালের ট্রেইন ধরার জন্য অপেক্ষা করি, তবে হয়ত চন্দ্রনাথ পাহাড় লিস্ট থেকে বাদ দিতে হতে পারে।

বিকল্প রাস্তা

হঠাথ আমার মাথায় আসল রাজশাহী বা দূর থেকে ছেড়ে আসা চট্টোগ্রাম গামী বাস যদি আমরা ধরতে পারি তাহলে হয়ত আমাদের স্কেজুয়েল ঠিক থাকবে। তাই ঠিক হল সবাই মিলে সায়েদাবাদ যাব। স্টেশন থেকে বের হয়েই দেখি সায়েদাবাদের যাত্রী নেয়ার জন্য বলাকা বাস অধির আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। উঠে পরলাম বাসে। ভাড়া ৩০ টাকা।

সায়েদাবাদ পৌঁছলাম রাত ২ টার কিছু পরে। দুপুরের পর থেকে পেটে ভারী দানাপানি কিচ্ছু পরে নি। ক্ষুধায় যে আমার চর্বি হজম হচ্ছিল তা ভালভাবেই বুঝতে পারলাম। এদিকে বাস ধরার চিন্তা, ক্ষুধা, সময় এই তিন জিনিস নিয়ে বিপদেই পরলাম।

সায়েদাবাদ নেমে দেখি আমাদের মত অনেক ট্রেন ফেইল করা হতাশ যাত্রীই সেখানে উপস্থিত। এদের অধিকাংশই ট্রাভেলার। দেখি বাসের অভাব নেই। হেল্পার আর দালালরা হানিফ, শ্যামলী সহ বিভিন্ন কোম্পানির বাসে উঠার জন্য ডাকা ডাকি করছে। অভিজ্ঞ বন্ধু জীবন দ্রুতই সুলভ খরচে সেন্টমারটিন ট্রাভেলসের এসি বাস জুটিয়ে ফেলল। ভাড়া ৫০০ টাকা।

একটা হোটেল খুলা ছিল। ঝটপট তেহেরি খেয়ে উঠে পরলাম বাসে। বাস ছাড়ল প্রায় রাত তিনটায়।

বাতাসের মত গতি

সারাদিন অনেক ক্লান্ত ছিলাম। বাসে উঠার পর একটু চোখ বুজলাম। চোখ খুলে দেখি চিটাগাং পৌঁছে গেছি। দেড় ঘন্টায় কিভাবে বাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছলাম তা আর মাথায় আসছিল না।

স্বাভাবিক ভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌছাতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লাগার কথা। কিন্তু ড্রাইভারের চালানো আর গাড়ির গতি দেখে বুঝলাম সবই সম্ভব। আমি যেভাবে Euro Truck Simulator 2 গেমএ ট্রাক চালাই, ড্রাইভার তেমন ভাবে বাস চালাচ্ছে।আমি প্রথমে বুঝার চেষ্টা করলাম যে আসলেই চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছি কি না! রাস্থায় চট্টগ্রাম হাইওয়ে পুলিশের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলাম।

কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার সাহেব এসে বললেন যে আমরা সীতাকুণ্ড পৌঁছে গেছি। সময় তখন সকাল পাঁচটা বাজতে কিছু মিনিট বাকি।

মিশন চন্দ্রনাথ পাহাড়

বাস থেকে নেমে হাইওয়ে থেকে নেমে পাহাড়ের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ার কারণে সিএনজি ভাড়া করলাম না। হাঁটতে হাঁটতে মাঝামাঝি রাস্তায় একটা মসজিদ খোলা পেলাম। ফজরের নামাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছিল। এখানে বলে রাখা ভাল, এই ভ্রমণে অনেক অয়াক্ত নামাজই কাজা হয়েছে।

মসজিদ থেকে ফ্রেশ হয়ে আউটফিট চেঞ্জ করে নিলাম। ভোর হওয়ার কারণে নাস্তার হোটেল তেমন খুলে নি। আরেকটু এগিয়ে পাহাড়ের কাছাকাছি একটা দোকান থেকে চা পান করে নিলাম। বোতলের পানিতে স্যালাইন মিশিয়ে উঠার জন্য রেডি হয়ে গেলাম।

পাহাড়ের নিচের দোকান গুলোতে লাঠি পাওয়া যায়। দাম ২০ টাকা। কিন্তু পাহাড় থেকে নেমে আবার ফেরত দিলে ১০ টাকা ফেরত পাওয়া যায়। আর ব্যাগ রাখারও বাবস্থা আছে। সেটার ভাড়াও ২০ টাকা। আমাদের ট্যুরের জন্য নেয়া কাপড় আর অন্যান্য জিনিস সহ চমৎকার ওজন সমৃদ্ধ ব্যাগটা টেনে প্রায় ১২০০ ফিট উপরে উঠানোর কোন প্রয়োজনই নেই। তাই সেগুলোকে দোকানে রেখে দিলাম।

অনেক উৎসাহ আর উদ্দীপনার সাথে আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে প্রায় সকাল ছয়টার সময় পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম।

৫ মিনিট পর ….

ইমন – আমি আর পারছি না।

আমি – একটু স্যালাইন খেয়ে নেই।

শামিম – এতটুকু উঠতেই এই হাল! বাকি পথ তাহলে ক্যামনে যাবা!

*জীবন – এত কষ্ট ক্যান অর * *!*

বাকী – গ্র্যাভিটি ছেলে গ্র্যাভিটি।

Mahmudul Hasan and his friends somewhere on the hill.
পাহাড়ের মাঝামাঝি কোন স্থানে

এই হচ্ছে আমাদের হাল! হা হা হা। যাহোক, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে রাস্তা আছে দুইটা। একটি উপরে উঠার, অপরটি নামার। যদিও উভয় রাস্থা দিয়েই উঠা ও নামা যায়। কিন্তু বিপরীত রাস্তা দিয়ে উঠা নামা করলে কিঞ্চিৎ বেশী কষ্ট হয় বলে ট্রাভেলারদের মন্তব্য। ভ্রমণে যাবার পূর্বে ইউটিউবে দেখা কিছু ভিডিও এই জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছে। পাহাড়ে উঠার রাস্তার কিছুদূর এগিয়ে ছোট্ট একটি কৃত্রিম ও প্রাকৃতিকের মিশেল ঝরনা আছে। সেখান থেকে এই দুই রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। আমরা যেহুতু অলস মানুষ, তাই উঠার রাস্তা দিয়ে উঠা শুরু করলাম।

আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’লার কি অপুরূপ সৃষ্টি, যতই উপরে যাই ততই বিমোহিত হচ্ছিলাম! প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাদের চলার গতি যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে, সকালের মেঘ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু অভিকর্ষের কারণে ক্লান্তি অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে চলার গতি থামিয়ে দেয়ার। এ দুই বিপরীত চেষ্টার যেন এক অসম লড়াই।

পাহাড়ে উঠার পথে বেশ কিছু দোকান আছে। এদের কাছে পাহারি কলা, বিভিন্ন রসাল ফল, পানি, হালকা খাবার ইত্যাদি পাওয়া যায়। এখানে একটা মজার ইকুয়েশন কাজ করে। আপনি যত উপরে উঠবেন, পণ্যর দাম সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকবে। আমরা খুব সকালে উঠা শুরু করেছি বিধায় দুই একটা ছাড়া উপরের বাকী দোকান গুলো বন্ধই ছিল। আমরা প্রথমে আর আমাদের পিছনে একটা দল ছিল। তাছাড়া তেমন কোন ট্রাভেলার ও সে সময় ছিল না।

পাহাড়ে উঠার পথে বেশ কিছু স্থানে বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ বা পাথরের সিট রয়েছে। আমরা কিছুদূর পর পর যাত্রা থামিয়ে স্যালাইন পান করছি আর চেষ্টা করছি না বসার। কেনন শরীর একবার আরাম পেয়ে গেলে আর পরিশ্রম করতে চাইবে না।

সৌন্দর্যের বর্ণনা আমি এখানে দিচ্ছি না, কেননা তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমাদের কাছে ইমন ছাড়া আর কারো কাছে স্মারটফোন বা ক্যামেরা ছিল না। তাই আমরা ছবি তোলার থেকে বাস্তব চোখ দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করার দিকে বেশী মনোযোগী ছিলাম। এসব গ্যাজেট সাথে না থাকায় আমাদের ম্যাক্সিমাম কনসেন্ট্রেশন ছিল রিয়াল লাইফের দিকে। যদিও কিছু ছবি তোলা হয়েছে অবশ্যই!

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে দুইটা হিন্দুদের মন্দির রয়েছে। একটি পাহাড়ের চূড়ায়, অপরটি একটু নিচে। উঠার রাস্তা দিয়ে উঠলে চূড়ার কাছাকাছি এক পর্যায়ে রাস্তাটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি চলে যায় সরাসরি চূড়ায়। অপরটি যায় নিচের মন্দিরে। সেখান থেকে চূড়ায় যাওয়ার পৃথক রাস্তা রয়েছে। আমরা প্রথমে নিচের মন্দিরের স্থানে গেলাম। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। সকালের ঠান্ডা বাতাস অন্তর জুরিয়ে দিল। মিনিট পাঁচেক রেস্ট নেয়ার পর আবার উঠা শুরু করলাম চূড়ায়।

চূড়ায় যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সকাল সারে সাতটা বাজে। উঠে দেখি একদল সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছে। চূড়ায় একটি মন্দির ও পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে।

Mahmudul Hasan and Zakir Hossen sitting on a fence at the top of the hill.
পাহাড়ের চূড়ায়

চূড়ার হরাইজন্টাল পজিশনে খুব কাছ দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। যেন একটু এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। এই প্রথম আমি এত কাছ থেকে মেঘ দেখলাম। এই মেঘ উড়ার দৃশ্য খুব ক্ষণস্থায়ী। খুব সকালে না উঠলে এই দৃশ্য দেখা যায় না। পাহাড় থেকে অনেক দূরে সমুদ্র দেখা যায়। আর দেখা যায় ছোট ছোট বাড়ি আর হাইওয়ে। কিন্তু বাকি তিন দিক শুধুই গাছ, পাহাড় আর বন। কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই।

আমরা বেশ কিছুক্ষণ মন ভরে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। ইচ্ছা করছিলা যদি সারা জীবন সেখানে কাটিয়ে দিতে পারতাম! কিন্তু তা কি আর হয়, ফেরত তো যেতেই হবে! তাই ক্যামেরার ফ্রেমে কিছু স্মৃতি আটক করে আবার নামা শুরু করলাম। নামার রাস্তা নিচের ছোট মন্দিরে না গিয়ে সোজাসুজি নিচে নেমে যায়। কিছুদূর নামতেই দুইটি রাস্তা পেলাম। একটি ডাকাতের উৎপাতের ভয়ে পড়িত্যাক্ত রাস্তা, অপরটি সচল সিঁড়ি দিয়ে নামার পথ। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম।

উঠার থেকে নামা যেন আরও দ্বিগুণ কঠিন। সিঁড়ির ধাপ অনেক বড় বড় হওয়ার কারণে অনেকটা লাফ দিয়ে দিয়ে নামতে হচ্ছিল। নামার পথে অনেকের সাথে দেখা হল যারা এই পথ দিয়ে উপরে উঠছেন। আরও দেখা হল স্থানীয় কিছু মানুষদের যারা বিভিন্ন পাহাড়ি ফল সংগ্রহ করে বিক্রয় করে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে দিনে কয়বার পাহাড়ে উঠেন, তিনি দিনে পনেরো বারের মত উঠানামা করেন বলে জানালেন। আমরা অবাক হলাম না। কেননা নিয়মিত উঠা নামা করার কারণে তাদের শরীর সেভাবে গঠন হয়ে গেছে।

নিচে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সকাল নয়টা বাজে। নেমে সবাই এক গ্লাস করে পাহাড়ি লেবুর শরবৎ পান করলাম। দাম ১০ টাকা ছোট গ্লাস ও ১৫ টাকা বড় গ্লাস। সেই দোকানে কিছুক্ষণ বসে থেকে খালি বোতল গুলো ভর্তি করে ব্যাগের কাছে চলে আসলাম। আমরা লাঠি আর ফেরত দিলাম না। স্মৃতি হিসেবে রেখে দিলাম। বিক্রেতা আন্টি একবার ফেরত চাইলেন, কিন্তু যখন বললাম যে রেখে দিব, তখন তিনি শুধু হাসলেন। (লাঠি নিয়ে ঘটা মজার ঘটনা গুলো গল্প এগুনোর সাথে সাথে বর্ণনা করব)

ব্যাগের বিল মিটিয়ে নাস্তা করে নিলাম। আমি, আব্দুল বাকী আর জীবন খেলাম ছোলাবুট আর লুচি। ছোলাবুটের দাম ১০ টাকা বাটি, আর লুচি ৫ টাকা করে। লুচি গুলো যথেষ্ট বড় আর ছোলাবুট দাম অনুযায়ী যথেষ্ট। অপরদিকে ইমন ও শামিম ভাই খেলেন পরাটা ও ডাল। এক বাটি ডাল ও পরাটা ৫ টাকা করে।

আমাদের এবারের গন্তব্য সহস্র ধারা ও সুপ্ত ধারা ঝর্ণা। তারপর খইয়াছরি ঝর্ণা। কিন্তু স্থানীয় ও সিএনজি চালক দের নিকট থেকে জানতে পারলাম যে ঝর্ণাতে পানি নেই। আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। পানি না থাকলে ঝর্ণাতে যাওয়া বৃথাই বলা যায়। সিদ্ধান্ত ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে নিলাম সীতাকুণ্ড বাজার পর্যন্ত। ভাড়া ৮০ টাকা।

যেতে যেতে সিধান্ত হল যে ঝর্ণার দিকে আর যাওয়া হবে না। আমাদের কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল রাতের বাসে। কিন্তু এখনই যাওয়ার সিধান্ত হল।

নতুন রুট প্ল্যান

সীতাকুণ্ড – কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, মেরিন ড্রাইভ ও হিমছড়ি ঝর্ণা – চট্টগ্রাম – ঢাকা – রাজশাহী

কক্সবাজারের পথে

সীতাকুণ্ড বাস কাউন্টার থেকে জানতে পারলাম এ.কে. খান বা অলংকার মোড় থেকে কক্সবাজার গামী বাস পাওয়া যাবে। ভাড়া ৩৫ টাকা। এর মাঝে একটি হানিফ বাস এসে উপস্থিত হল এবং আমাদের কক্সবাজার পর্যন্ত ভাড়া ৪০০ টাকা নিবে বলে জানাল। আমরা আর কিছু না ভেবে উঠে পরলাম। এই ৪০০ টাকা ভাড়ার ঘটনা মনে রাখবেন, এই নিয়ে পরে গল্প আছে। যাহোক বাসে উঠার পর জানতে পারলাম যে এই বাস কক্সবাজার যাবে না কিন্তু কক্সবাজার গামী অন্য বাসে উঠিয়ে দিবে। কথা অনুযায়ী বাস টারমিনালে পৌঁছল এবং আমাদের কক্সবাজার গামী বাসে উঠিয়ে দিল। প্রায় পৌনে বারটার দিকে আমাদের বাস কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল।

এই ছিল আমার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠার গল্প। পরের গল্পে কথা হবে কক্সবাজার, হানিফ বাস, ৪০০ টাকা ভাড়া ও হোটেল নিয়ে। এতক্ষণ কষ্ট করে মনোযোগ দিয়ে আমার আগোছালো গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পরের গল্পে থাকছেন তো!

খোদা হাফেজ। ❤

© 2024 by Mahmudul Hasan. All rights reserved.