Skip to content
Mahmudul Hasan

সিরাজাম মুনিরা মুহাম্মদ মুস্তফা সাঃ

Collected, Miscellaneous10 min read

সৈয়দ ফররুখ আহমদ (জুন ১০, ১৯১৮ – অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। এই বাঙালি কবি মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্‌প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তার কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। (উইকিপিডিয়া)

সেপ্টেম্বর, ১৯৫২ সালে প্রকাশিত সিরাজাম মুনীরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাঃ কে নিয়ে রচিত এক অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ। নিচে সেটি উপস্থাপন করা হল।

সিরাজাম মুনীরা মুহম্মদ মুস্তফা

(সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ-সাল্লাম)

ফররুখ আহমদ


পূর্বাচলের দিগন্ত নীলে সে জাগে শাহানশাহের মত

তার স্বাক্ষর বাতাসের আগে ওড়ে নীলাভ্রে অনবরত।

ঘুম ভাঙলাে কি হে আলাের পাখী? মহানীলিমায় ভ্রাম্যমাণ

রাত্রি-রুদ্ধ কণ্ঠ হ’তে কি ঝ’রে এবার দিনের গান?

এবার কি সুর ঘন অশ্রুর কারা তট থেকে প্রশান্তির?

এবার সে কোন আলাের স্বপ্নে তাকাবে ক্ষুদ্ধ প্রলয় নীর?

এ বােবা বধির আকাশে এবার তুলবে কি তার নীরবতাকে

সেই মুসাফির সুদূরচারীর সুগভীর সুরে দরদী ডাকে?

ঐ আসে আসে সেই বিহঙ্গ সাহরী তার শ্বেত পাখায়,

আকাশের বুক ঘন হয়ে ওঠে নীল মরকত স্বচ্ছতায়,

সােনালী আলােয় শ্বাপদ রাত্রি আহত, লুপ্ত নিমেষ মাঝে;

থির-বিদ্যুৎ আভা তরঙ্গ আলােকে সুর আকাশে বাজে।

হে অচেনা পাখী কোন্ আকাশের গভীরতা হ’তে এসেছ উঠি?

তােমার পক্ষ-সঞ্চারে ভাষা-ভাবের কুসুম উঠিছে ফুটি;

তােমার জরিন জরির ফিতায় নিখিল মানস করো জরিপ

কত অজ্ঞাত সাগরে সহসা ভেসে ওঠে কত সােনার দ্বীপ,

ভাষা-মুখরিত তােমার পাখায় সব সাগরের অশ্রুজল,

তােমার ছায়াকে চুম্বন করে তরুণ মনের লাল কমল,

আলাে-বিহঙ্গ! মুক্ত নীলের সকল রশি ঝরোকা চেন,

তােমার পতির ইঙ্গিতে তাই নিখিল স্বপ্ন ফুটছে যেন।

অন্ধ রাতের তুমি নও, তুমি নও মৃত স্থবিরতার

সব আকাশের দুয়ার খুলেছো, খুলেছো সরুল মনের দ্বার,

তোমার আসার পথ চেয়ে চেয়ে আবেগে সকল আকাশ কাঁপে,

মুক্তপক্ষ, হে আলো! ধন্য ধরণী তােমার আবির্ভাবে।

কে আসে, কে আসে সাড়া পড়ে যায়,

কে আসে, কে আসে নতুন সাড়া।

জাগে সুষুপ্ত মৃত জনপদ, জাগাে শতাব্দী ঘুমের পাড়া।

হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি আলাে প্রিয় আবহায়াত,

জানি সিরাজাম-মুনীরা তােমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত,

তব বিদ্যুৎকণা-স্ফুলিঙ্গে লুকানাে র’য়েছে লক্ষ দিন,

তােমার আলােয় জাগে সিদ্দিক, জিনুরাইন, আলী নবীন,

ঘুম ভেঙে যায় আল ফারুকের-হেরি ও প্রভাত জ্যোতিষ্মান

মুক্ত উদার আলোক তােমার অগণন শিখা পায় যে প্রাণ।

তুমি না আসিলে মধু ভাণ্ডার ধরায় কখনাে হ’ত না লুট,

তুমি না আসিলে নার্গিস কভু খুলতাে না তার পর্ণপুট,

বিচিত্র আশা-মুখর মাশুক খুলতাে না তার রুদ্ধ দিল;

দিনের প্রহরী দিত না সরায়ে আবছা অীধার কালাে নিখিল।

তাই সে যখন এল এ ধরায় সে নবী যখন আবির্ভূত

দেখে এ বিশ্ব বিস্মিত চিতে সে দূতের তনু মহিমা পূত,

নিখিল ব্যাপ্ত তার অন্তরে পর্বত হ’তে পথের ধূলি,

এ-হাতে বজ্রনির্ঘোষ যবে ও-হাত এনেছে গোলাব তুলি,

ক্লিন্ন তিমিরে যাত্রীরা যবে দেখে সম্মুখে শ্বাপদ ভূমি।

এমন সময় হে জ্যোতির্ময় নূরানী চেরাগ আনলে তুমি।

‘কে আমি, জানালে তুমিই প্রথম হে মেষপালক উম্মী নবী।

দীপ্ত সূর্য আলাে আরশিতে ধরিয়াছে কাল তােমারি ছবি।

সে এল, সে এল রাজার মত সে এ-ধুলিতে তবু দীনের মত,

পুষ্পকোমল তার অন্তর হ’ল বিক্ষত কাটায় ক্ষত,

তবু সে জাগলাে মেশকের বাস, জাগালাে মরুতে গুলে আনার

ইব্রাহিমের পরশে যেমন ফুল হ’য়ে ফোটে কুব্ধ নার।

দেখেছি তােমায় মানবতা চলে সাথে জনগণ বিপুল দেহ

ক্লেদাক্ত পথে ফোটায়ে মুকুল সাজালাে তাদের ধরণী গেহ,

যে মরুতে জানি ফুল ফোটেনাকো, যেখানে উষর পৃথ্বীতল,

সেখানেও তুমি জাগালে শস্য, আনলে অঝাের ধারা বাদল।

তবু ভাঙলাে কি, ঘুম ভাঙলাে কি, ঘুম ভাঙলাে এ অন্ধদের?

আজ বিস্মৃতি তােলে যে আড়াল তােমার দিনের এই দিনের।

এখানে যে স্নান কদর্যতার ছবি আর ক্ষুধা যায় কি সেথা,

গড়ায় বিপুল অজগর তার লেলিহান ক্ষুধা, বিপুল ব্যথা,

আকাশে আকাশে তারি বিষাক্ত প্রশ্বাসে হেরি মুর্ছাতুর

আলাে-বিহঙ্গ ভােলে যে সূর্য, তােমার শেখানাে পথের সুর।

মনে জাগে সেই ঘনতর বিষ, বিশ্ব আরব গগনে মেঘ

অত্যাচারীর হাতে পীড়িতের সে কী দুর্ভোগ, কী উদ্বেগ।

মুক পশু সম মার খেয়ে মরে খরিদা গােলাম বাদির দল

শিশু হত্যার মৌসুমী যেন, পাপে কেঁপে ওঠে জলস্তুল,

শারাব শােণিতে মাতাল মানুষ মানবতাহীন নর্দমায়

পুরীষ মাথায় শুভ্র ললাটে কদর্যরুচি পশুর প্রায়,

নাস্তিকতায় বহুত্ববাদে, ব্যভিচারে ছানি প’ড়েছে চোখে

কাবাগৃহ তারা সাজায়ে পুতুলে অন্ধের মত কপাল ঠোকে,

পথে কেঁদে ফেরে এতিম শিশুরা সর্বহারার বিরাট দল,

জালিমের হাতে মার খেয়ে খেয়ে বৃথা মােছে তারা নয়নজল।

আজো যেন শুনি ওরা দুটি টিপে মারছে শিশুকে সদ্যজাতা

অসহায় শিশু কণ্ঠের শেষ গােঙানিতে কাপে খেজুর পাতা,

বালু চাপা দিয়ে শ্বাস রােধ করি জাগে পিশাচের কলোল্লাস,

কেঁদে ওঠে ধরা বুকে ধ’রে সেই দুধের বাচ্ছা শিশুর লাশ।

হাটে ও বাজারে কেনা দাস-দাসী মানুষ লুটালাে প্রেতের করে

মানবতাহীন কসাইয়ের হাতে তাদের হাড়ের চামড়া ঝরে।

সত্যধর্ম মুছেছে তখন তিমির লুপ্ত ধরণী হ’তে

শুধু নীচু মুখে ভয়াল গতিতে নামছে বিশ্ব ধ্বংস স্রোতে।

নিখিল-বিশ্ব উষা নেমে এলে বুকে নিয়ে এলে আলাের রেখ

সে দিন কি দুলে উঠেছিল ধরা নওশেরােয়াঁর ভেঙেছে দার?

নিভেছে পৌত্তলিকের হাজার বছর জ্বালানাে কুহুক নার?

দুম্বার শাবক ঘাস ফেলে দিয়ে শোনে কি অজানা সুরের গান

অন্তে চাঁদের রশি কি চায় দিনের সূর্যে জোয়ার টান?

হায়রে অনাথ এতিম শুধুই মার কোলে দোলে পিতৃহারা।

তার পরে কবে মা-হারা শিশু পথে পথে মোছে অশ্রু-ধারা,

মাঠে মাঠে করে দুম্বা চরাতে সে শিশু বুঝেছে ব্যথা অপার

বাণিজ্য পথে বােঝা টেনে টেনে সে বুঝেছে ব্যথা মানবতার।

লু’ হাওয়ায় ওড়ে মরুর কারুর সূর্য-শিখায় ভয়ঙ্কর,

অগ্নিদাহন তোমার কোমল তনুতে হানে সে অগ্নিশর,

ঈশান কোণের ঝড় উড়ে আসে, সাথে ব’য়ে আনে মরুর ধূলি,

কিশোর কণ্ঠ জ্বলে পিপাসায়; জলে ক্ষুধাতুর পাকস্থলী,

বত্রিশ নাড়ী ছিড়ে পড়ে বুঝি ক্ষুধার ধমকে ধমনী কাঁপে,

বাবলা কাঁটায় বিক্ষত দেহ, পিঠ নুয়ে আলে বােঝার চাপে,

আঁসু ঝরে আর কলিজার খুন ঝরে সিরিয়ার বালুর মাঠে,

খেজুর কাণ্ড উপাধান শিরে কিশাের তােমার রজনী কাটে।

কোন্ সে অটল কারিগর তার কঠিন আঘাতে অনবরত

বারবার হানে আর চেয়ে দেখে হ’ল কিনা তার মনের মত।

হাজার ব্যথার আগুনে পােড়ায়ে মরুর হাপরে হাজার দিন

সুন্দরতম তব অন্তর ব্যথার রঙে সে করে রঙিন।

তখন তােমার বিশাল হৃদয় বুঝেছে দুঃখ দীন দুখীর

জীবন কাটায়ে অনশনে হয় বুঝেছে কী জ্বালা ভুখা প্রাণীর,

জেনেহে বন্দী বনি-আদমের দুঃখ; কোথায় ব্যথা নারীর।

কোন কারিগর দিয়াছে তােমার ঐ সুবিশাল নয়নে নীর।

মরুআকাশের গভীরতা সেও হার মানে ঐ বুকের কাছে।

তােমার খোর্মা মুঠি বিলি করে তুলে নিয়ে তুমি মুখের কাছে।

তারপর এল হেরা গহ্বরে তিমির পাথারে ধ্যানের দিন

পরম সত্য খুঁজবার তরী ভাসে সেই স্রোতে সাথীবিহীন,

মরু মক্কার চোখের মণি সে সত্য দীপ্ত আল-আমিন

হেরার গুহায় মােরাকাবা-লীন খোঁজে সে সত্য প্রেম রঙিন।

মরু প্রশ্বাসে বালুকাবেলার পটে বদলায় রাজ্যপাট,

দিনের দরজা বন্ধ করিয়া পড়ে রাত্রির কালাে কপাট,

জ্বলে অসংখ্য সেতারার বাতি গভীর নীলায় তন্দ্রাহীন

ঘুমহারা চোখে হে সাধক! তব শর্বরী কাটে ব্যথামলিন।

স্তব্ধ নিথর থমথম করে তােমার আকাশ তােমার মন,

মরুর পিপাসা নিয়ে তুমি করাে আত্নার বারি অন্বেষণ,

ব্যাকুল আশায় হেরার শিখরে খুঁজে ফেরাে তুমি আবহায়াত

সূর্ব-শ্রান্ত দিনশেষে নামে দীর্ঘ তােমার ধ্যানের রাত।

একাগ্রতার সকল সেতারা চেরাগ জ্বালায়ে মনের সাধ

খোঁজো হে সাধক মৌন পরম সত্য-স্রষ্টা আল-আহাদ,

খুঁজে ফেরে তুমি লা-শরীকে মহান সত্য অভিজ্ঞান।

মরুর পিপাসা অশ্রু ভিজায়ে জাগাও দু’চোখে কী সন্ধান।

হে একাগ্রচিত্ত্ব সাধক ঘরছাড়া হায় সাথীবিহীন।

কোন জয়তুনী স্মৃতিকথা বহি জাগাে অ-শ্রান্ত রজনী-দিন?

হেরার কাঁকর ফোটে না কি পায় মরুর সূর্যে জ্বলে না দেহ?

কোন আলোকের আশায় ছাড়লে খেজুর ছায়ার শাস্তি গেহ।

প্রবল তৃষিত লু হাওয়ার শিখা সে কী হার মানে ঐ আবেগে,

ঝড়ের মতন সারা তনুমন কাঁপে ঈশকের আগুণ লেগে।

যে অঝোর ধারা ঝ’রছে নয়নে ‘অলবুর্জের অশ্রুভার

কেঁদে কয়-কবে শেষ হবে তার প্রতীক্ষা-নিশি নীরবতার।

ঘুমায় আরব-আজম বিশ্ব জয়তুন শাখে শিশিরপাত,

হায় ঘুমহারা। তােমার সমুখে জাগে নিশিশেষে স্নান প্রভাত,

তবুও তােমার সেতারার শিখা জ্বলে অম্লান দীর্ঘ যাম,

পরম জ্ঞানের সন্ধানে ঐ দু’আখির হয় নাই বিরাম

ভেঙে পড়ে দেহ, শীর্ণ ও অনু- ক্রন্দনে সারা মন বিবশ

জয়তুন পাতা ঝরে পড়ে বুঝি নিঙাড়িয়া প্রাণ-সবুজ-রস।

এমন সময় মরু বিয়াবান কাঁপায়ে প্রবল ঝঞ্ঝাস্বর।

কালের তীব্র ঘন্টার ঝড়ে নেমে এল নীচে মহা খবর

নূরের বিভায় দীপ্ত পরম সত্য বারতা অনির্বাণ

দিশাহারা পাখী তােমার কণ্ঠে নামলাে প্রজ্ঞাময় কোরাণ।

কোন্ অরণ্য বিদ্যুৎ ঝড়ে চাপা পড়ে স্নান জোনাকি শিখা

দিক্ দিগন্তে তােমার মনের জাগলাে জ্যোতির্দীপ্ত লিখা।

প্রবল বাজুতে টেনে নিয়ে ঐ বিরাট নিখিল তরানাে দিল

বলে, ‘পাঠ করাে’ ফুকারে বিশাল দীপ্ত বক্ষ জিবরাইল।

তাসবির সম তুমি বিম্বিত হে মেষপালক উর্মী নবী,

মহান জ্ঞানের সম্মুখে এসে দাড়ালে নীরব হেরাব-রবি।

স্তব্ধ তখন আকাশের গায় খেজুর শাখার প্রান্তসীমা

বিস্মিত ধরা চোখ ভরে দেখে তার দুলালের মহা গরিমা,

খুলি হে সকল আকাশের দ্বার, তারকাবিদ্ধ নীল কপাট

তােমার প্রভুর নামে বুক ভারি হে নবী তখন নিতেছ পাঠ…

কোরাণের নুর বুকে পুরে নিয়ে দাঁড়ালে যখন মরুর পথে

মহাবেদনায় দেখলে মানুষ ভাসছে পাপের কলুষ স্রোতে।

সে কী অনাচার! সে কী ব্যভিচার! বীভৎস ক্রূর আঁধি বিলীন,

ভয়াল ঘৃণায় ন্যক্কার তােলে শতাব্দী পথে রাত্রি দিন।

পুতুলে সাজায়ে কাবাঘর কাবা মাথা ঠুকে মরে পাপ-মাতাল,

অজ্ঞতার এ কুয়াশার ভিতে বসে মুর্খেরা ফেলিছে জাল,

যত কলুষিত পচা শাস্ত্রের বাসি রসে ভরি মাতাল মন

মৃত জড়তার অশেষ আঁধার পচাবিষ দ্বারা করে বমন।

সেদিন তমসা শিখরে নূরানী জয়তুন চারা করি রােপন

প্রােজ্জ্বল দীপ এলে সিরাজাম মুনীরা জাগায়ে অযুত মন।

মানবমুক্তি পণ নিয়ে তুমি ওঠো দুর্গম শিলা শিখরে,

প্রতি পাথরের প্রাকার পারাতে আহত তোমার রুধির ঝরে,

হে বীর! সেখানে পাথরের মত অটল তােমার পদক্ষেপ,

শিলা পার হ’য়ে পীড়িতের বুকে ঝর্ণাধারার দাও প্রলেপ

যেদিন শোনালে সাফার শিখরে সত্য হে নবী মুহম্মদ

সেদিন তােমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালাে হাজার শােণিত নদ।

আল্লা ব্যতীত নাই উপাস্য, মুহম্মদ সে তাঁর রসুল।’

জানালে যেদিন, তিমিরবর্তে বত্র যেদিন ভাঙালাে ভুল;

আলােক-অন্ধ শ্বাপদ সেদিন আসে প্রাণপণ, হানে ছােবল;

তুমি অপচল অাল্লার দূত দাড়ালে সেদিন শিলা-অটল।

জ্যোতির পাপড়ি কাটায় ছিড়তে চায় জংধরা পাষাণ দিল,

বাধার পাথরে প্রতিরােধ জাগে, জাগে শয়তান আবুজিহিল,

পাহাড়ে তােমার কেটে যায় কত দীর্ঘ দিনের অন্তরীণ

পশু ও পাখীর আহার্যে তবু হয় না মুখের হাসি মলিন,

তায়েফে শােণিত-স্নান করি তুমি বল ; তিনি এক লা-শরীক,

হেরার সূর্য। তখনাে আকাশ লুপ্ত, তিমিরে ভরানাে দিক।

প্রবল আঘাত শােণিতে, যখন মহাজ্ঞান তোমার তনু ও মন

তখনাে ধ্যানের আলােক-পাখায় মহাজ্ঞান করে অন্বেষণ,

তখনাে জ্ঞানের পর্দা অড়ালে খুঁজেছে সত্য শ্রান্তিহীন,

প্রজ্ঞা- পথিক! যে সমুদ্রর জোয়ার ভাটায় রাত্রি দিন,

দুই রঙা পাখী পাখা মেলে দিয়ে, ভাসছে যেখানে বারি অতল

তারি তলে ডুবে তুলে আনে কোন্ অজানা জ্ঞানের মুক্তাফল।

মুহম্মদ কে শুধালে যখন আয়েষা তখন নিরুত্তর ;

মুহম্মদ কে ? কে জানে সেকথা কে জানে জ্ঞানের গুঢ় খবর?

তুমি জানাে নিজ অনস্তিত্ব, মাটির কাহিনী, প্রভুর দানে

নূরানী কলবে তারকা ছিটায়ে ওড়ে সে উর্ধ্বে আকাশ পানে।

সে মাটি পেয়েছে দারাজ বাজুতে আকাশ পারের প্রবল ঝড়

পার হ’য়ে যায় মরু সাইমুম তীব্রচ্ছটা ভয়ঙ্কর,

রাত্রি মুগ্ধ বেষ্টনী হতে ছিটে পড়ে তারা নীহারিকার,

সকল আকাশ ধরা দেয় এসে বিপুল সবল মুঠিতে তার।

তারপর তার শান্তি আকাশ বাড়ে ক্রমাগত ধ্যানের রাত

নিজের কাহিনী স্মরণ করিয়া মৃত্তিকা করে অশ্রুপাত।

এমনি সে কোন্ নীরব নিশীথে এল বােরাক বহিয়া জ্যোতি,

মায়াভরা রাত, শুক্লা প্রভাত, বিদ্যুৎ ঝড়, বিপুল গতি।

জানি না সে কত আকাশ পারায়ে পরলে প্রথম মােতির তাজ

প্রতীক্ষায় সে স্বর্ণ-নিশীথে নামলাে পূর্ণ শবে মেরাজ,

সেদিন পূর্ণ মাটির মানুষ আনলে যে দান পূর্ণতার

আরব-উষর নিবিল চিত্তে আজো সে জাগায় গুলে আনার

মক্কার মরু নিল না তোমার প্রাণরসে-ভরা আবহায়াত,

দূর ওয়েসিস পারে মদীনার দরদী আকাশ বাড়লো হাত।

সেথা’ও মক্কী সাপের জনতা নিয়ে গেছে তার হিংসানল

সেখানেও তারা হেনেছে ও-বুকে বিষাক্ত ছুরি, বিষ-ছোবল,

বদর-ওহােদ, মরুপ্রান্তরে ঘিরে যবে হানে মৃত্যুতীর।

তখনাে সকল মৃত্যুর মাঝে সিপাহসালার রইলে স্থির,

লক্ষ মৃত্যু উদ্যত দুবু হে মহাসেনানী পাও না ভয়,

বিশ্বিত চোখে আলী হায়দর দেখে ঐ তনু জ্যোতির্ময়,

হামজা শিহরে পুলকিত বীর জাগলাে কি ফের অস্ত্র তার

দুহাতে দু’ধারী তলওয়ার নিয়ে হাঁকে, হে সেনানী! জয় তােমার।

জোড়াতালি দেওয়া, রােদে ভেঙে পড়া নির্যাতিতের ভাঙা মিছিল

তােমার হাতের ইশারায় খোলে মরুদূর্গের সকল খিল।

তারপর এল তােমার প্রভুর প্রতিশ্রুত সে জয়ের দিন

মহাগৌরবে এল ফতহুম মুবিন-শান্তি দীপ্ত দিন।

দীর্ঘ রাতের প্রতীক্ষার ঐ মরুকন্টকে রঙিন লাল

ফুটলাে গােলাব দিকদিগস্তে আজান ফুকারে সাথী বেলাল।

অটল তােমার ধৈর্য হে নবী! সুন্দরতম সে অপরূপ,

তোমার আলােয় জেগে ওঠে কোটি সুদূর প্রাচীন অন্ধকূপ,

অমনি অন্ধ কূপমণ্ডূক সাত সাগরের সিন্দবাদ

নােনাপানি চিরে দ্বীপে বন্দরে নতুন দিনের করে আবাদ,

সাগরে সাগরে নীল স্রোত চিরে ওঠায় ফসল মারজানের,

পাখা মেলে কোথা আকাশ-নাবিক মুসাফির দূর বন্দরের,

সূর্য ফলায় চাষ ক’রে যায় রাত্রি বিরাণ অধিত্যকা।

হারানাে সাথীরে খুঁজে পায় ফের বিস্মৃত পথে বিরহী চখা

ব’য়ে আনে কোন্ দিগন্ত হ’তে পূর্ণিমা চাঁদ সুরভিসার।

রসে ফেটে পড়ে জেরুজালেমের গুলশান লা’লা রাঙা আনার।

কোথায় গেল সে দুর্নীতি আর ক্লেদ ব্যভিচার ভরা পুরীষ।

কোথায় গেল সে মানবতাহীন যাত্রী দলের বুকের বিষ।

জিঞ্জীর ভার খ’সে পড়ে গেছে লুটায় বেহেশত্ পায়ের তলে।

জীবন্ত শিশু কোলে নিয়ে নারী ভাসে আনন্দ অশ্রুজলে,

আসে দলে দলে নবীন নকীব, উজ্জীবিত সে মানবদল,

ভরে তকদির পূণ্যধ্বনিতে শূন্য নীলিমা জলস্থল,

ধর্মবিহীন তার্কিকও আজ সাক্ষ্য দেয় সে লা-শরীক

‘আল্লার নাই অংশী মুহম্মদ তাঁর দাস জেনেছি ঠিক।

বুঝেছে সত্য মরুর দুলাল সঙ্গী সুফফা মহামানব

আবহায়াতের ধারায় লেগেছে শতাব্দীর ও প্রাচীন শব।

জ্বলে ভঙ্গুর মৃত শামাদানে চিরন্তনের অভিজ্ঞান

আকাশে আকাশে তারি আহ্বান, পাতার শিয়রে তারি আজান।

তুলেছে কি ভুলি রংগিন তুলি ঝঞ্চাক্ষুদ্ধ প্রলয় নীলে।

চোখের পলকে সকল ক্ষুব্ধ ভয়াল ঝটিকা থামায়ে দিলে।

জাগলাে আবার সাদা বাঁকা রেখা ইঙ্গিত দিয়ে পথ চলার

অমনি মুক্ত সুপ্ত স্তুরে কওসর ধারা সাত তলার,

শুকনাে রুক্ষ বালু ভিজে ওঠে প্রেম-অশ্রুতে পূর্ণ বুক,

শিশির ভেজানাে গােলাবী পাপড়ি চায় বুলবুলি চায় মাশুক।

তাই নির্জন-চারী ওয়ায়েস করণির বুকে রঙের ঢেউ,

কেমন ক’রে যে কাটে তার দিন তুমি ছাড়া আর জানে না কেউ।

ভাণ্ডার ভরা সব সম্পদ বিলালে ব্যথিত মহৎ-মনা

ও মাটির নীড়ে তবু অক্ষয় রইল অশ্রু সমবেদনা।

ধ’রেছাে মুচির সূচ নিজ হাতে, ইট ব’য়ে তুমি হ’য়েছ কুলি

ইহুদির কাছে মার খেয়ে হায় ভরালে কি ঐ ছিন্ন ঝুলি।

মানুষের লাগি, উম্মত লাগি একী দানে ভরা পরাণপণ-

পরশ প্রভুর কাছে দীনতায় এ সুন্দর সমর্পণ।

পুরানাে রাতের চাঁদ ক্ষ’য়ে উঠেছে আকাশে নতুন চাঁদ,

সে চাঁদই নিভেছে কালো অঙ্গারেন, পার হ’য়ে মরু নীলার বাঁধ

তােমার কুটীয় দ্বারে হয় কত খও শশীর আবির্ভাব,

তবুও মক্কা-মদীনার রাজা মেটে না তোমার গৃহে অভাব,

উনানে চড়ে না আহার্য, কাটে ক্ষুধিত তােমার কত না রাত

মানুষের লাগি উম্মত লাগি তবুও ক’রেছাে অশ্রুপাত।

জ্বলে না কুটীরে চেরাগ, জ্বলে ও-ব্যথিত বক্ষে প্রেমের শিখা

জ্বলে ও-মাটির শামাদানে লাল ফিরদৌসের স্বপ্ন লিখা।

গলেছে পাহাড়, জ্বলছে আকাশ, জেগেছে মানুষ তােমার সাথে,

তােমার পথের যাত্রীরা কভূ থামেনি চরম ব্যর্থতাতে,

তাই সিদ্দিক পেয়েছে বক্ষে অমন সত্য সিন্ধু-দোল,

তাই উমরের পাতার ডেরার নিখিল জনের ও কলরােল

তাই ওসমান খুলে গেল দ্বার অতুলন দিল মণিকোঠার,

তাইতো আলীর হাতে চমকায় বাকা বিদ্যুৎ স্কুলফিকার,

খালেদ, তারেক ঝাণ্ডা ওড়ায় মাশুকের বুকে প্রেমের টান,

মহাচীন মুখে ফেরায়ে কাফেলা জ্ঞান যাত্রীরা করে প্রয়াণ।

পাল তুলে দিয়ে কিশতি ছুটছে জোয়ার ভাটার মাঝে অটল

নতুন তুফানে কোটি মরাগাঙ ধমনীতে গেল নতুন বল,

তারা খুঁজে ফেরে সিন্ধু ঠিকানা প্রবল তৃষার বারি অতল,

মৌসুমী ফুল জাগায়ে দুধারে বর্ষ শেষের তােলে ফসল।

মানুষের হাতে সকল পথেয় দিয়ে কামাল-সম্ভাবনা

সব কাজ শেষে মরু-আফতাব হ’লে কি এবার অন্যমনা?

আজ এতদিনে হ’ল কি সময় আবার নতুন পথ চলার।

পরম প্রিয়ের ডাক এল নাকি? আকাশ মহলা সাত তলার।

ওপার থেকে সে মহা কারিগর ডাক দিল নাকি হে নূরনবী?

মরুর আকাশ রােশনিতে ভরি এবার কোথায় জাগবে রবি?

এখানে তােমার নিশীথারণ্য ? কোথায় তোমার ফুটেছে যুঁই?

সে কোন স্বর্ণচামেলি বনের আভায় এ মাটি হ’ল বিভুই?

ফিরদৌসের কোন গুলশানে ‘সী-বিহঙ্গ উঠলাে ডেকে

চ’লে গেলে তুমি ও-মাটির ফুলমৃত্তিকা তনু ধুলায় রেখে,

যেথা সুন্দর গোলাবী পাপড়ি অক্ষয় বসে নিত্য লাল

চ’লে গেলে সেথা তারি ছায়া মুক্তি পথেয় আল-হেলাল।

তােমার পথের প্রতি বালুকায় এখনাে উদার আমন্ত্রণ,

ঘাসের শিয়রে সবুজের ছােপ জাগায়ে স্বপ্ন দেখিছে বন।

তব শাহাদাৎ, অঙ্গুলি আজও ফিরদৌসের ইশারা করে,

নিখিল ব্যথিত উম্মত লাগি এখনাে তােমার অশ্রু ঝরে,

তােমার রওজা মুবারকে আজও সেই খােশবুর বইছে বান,

চামেলির ঘ্রাণ, অশ্রুর বান এখনাে সেখানে অনির্বাণ।

চলেছে ধ্যানের জ্ঞান-শিখা ব’য়ে জিলানের বীর, চিশতী বীর

রঙিন করি মাটির সূরাহী নকশবন্দের নয়নে নীর,

জ্ঞানের প্রেমের নিশান তুলেছে হাজার সালের মুজাদ্দিদ

রায় বেরেলির জঙ্গী দিলীর ভেঙেছে লক্ষ রাতের নিঁদ

ওরা গেছে বহি তােমার নিশান রেখে গেছে পথে সেই নিশানি,

তবু সে চলার শেষ নাই আর, কোনদিন শেষ হবে না জানি।

লাখাে শামাদান জ্বলে অফুরান রাত্রি তোমার রশ্মি স্মরি

সে আলাে বিড়ায় মুখ তুলে চায় প্রাণ পিপাসায় এ শর্বরী।

সুর্মা গভীর আকাশের চোখে অশ্রুসজল বৃষ্টিধারা,

নতুন তারার পথ চেয়ে চেয়ে নীহারিকা হ’ল দৃষ্টিহারা।

বিরাট প্রসার মহা-পটভূমি তােমার বেলায় ইতস্তত

অশেষ সম্ভাবনার পলিতে দূরন্ত মরু ঝড়ের মত

যারা এঁকে আসে নতুন মাটিতে সুদৃঢ় ছাপ পথচলার

দীপ্ত চুরিতে ভাঁজ কেঁটে কেটে অসাড় হিমির স্থবিরতার;

তাদের সঙ্গে সালাম জানাই হে মানবতার শাহান শাহ।।

হে নবী! সালাম : সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ।।

© 2024 by Mahmudul Hasan. All rights reserved.