সূরা বুরুজের ৪ থেকে ৮ নং আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন –
“কুন্ডের অধিপতিদের হত্যা করা হয়েছিলো, ইন্ধনপূর্ণ যে কুন্ডে ছিলো অগ্নি। যখন তারা এর পাশে বসে ছিলো এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিলো তা প্রত্যক্ষ করছিলো। তারা তাদের নির্যাতন করছিলো শুধু এ কারণে যে তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসনীয় আল্লাহর উপর।“
ইনশাআল্লাহ আমি এই পর্বে আবরাহা আশরামের উত্থান আলোচনা করব, এবং পরের পর্বে রাসূল সাঃ এর জন্মের ৫০/৬০ দিন পূর্বে আবরাহার ঘটনাও উল্লেখ করব।
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম।
ঈসা আঃ এর ঊর্ধ্বগমনের বেশ কিছুকাল পরে তখন ইয়েমেনের শাসনে ছিলো হিময়ার গোত্রের যুশানাতির নামক রাজ পরিবার। ভাইকে হত্যার দায়ে তৎকালীন শাসক আমর ইবনে তুব্বাত নিদ্রাহীনতায় মারা গেলো, হিময়ারি শাসনে বেশ বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো এবং এ সুযোগে ইয়েমেন বাসিদের ঘাড়ে চেপে বসল লাখানিয়া ইয়ানুফ নামের এক ব্যাক্তি যে কি না যুশানাতির পরিবার বহির্ভূত একজন হিমইয়ারি। সে তাদের সকল সৎ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকদের হত্যা করল এবং যুশানাতির রাজ পরিবার কে পঙ্গু করে ফেলল।
এই লোক ছিলো ভয়ংকর রকমের পাপাচারী। সে সুদর্শন কিশোরদের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হত। একদিন তার এহেন ঘৃণিত কাজে ব্যাবহারের জন্য সে ডেকে পাঠায় যুশানাতির পরিবারের যুনুয়াস ইবনে তুব্বান আসয়াদ কে। লাখআনির দূত তাকে ডাকতে গেলে সে তার কুমতলব বুঝতে পারে এবং একটি ছুড়ি তার জুতার তলায় লুকিয়ে নেয়। লাখআনি গোপনে তার উপর চড়াও হতে উদ্যত হলে যুনুয়াস ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাকে মেরে ফেলে এবং মাথা আলাদা করে উঁচু মিনারে ঝুলিয়ে দেয় যেনো সকলের দৃষ্টিগোচর হয়।
জনগণ তার এহেন সাহসিকতা দেখে তাকে ইয়েমেনের রাজা বানিয়েফেলে এবং যুনুয়াশ ইয়েমেনে দীর্ঘস্থায়ী পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। যুনুয়াশ ছিলো হিময়ারি গোত্রের শেষ সম্রাট এবং সে ইউসুফ নামেও পরিচিত ছিলো।
ইয়েমেনের নাজারানে আল্লাহ প্রেরিত ঈসা আঃ এর নবুয়াত তখনো অবিকৃত ছিলো এবং ঈসা আঃ এর অনুসারীরা সেখানে বসবাস করত। যুনুয়াশ ছিলো ইহুদী এবং বলা বাহুল্য যে মূসায়ী নবুয়াত তখন রদ হয়ে গেছে এবং বিকৃত হয়ে আসল তাওরাতের ছিটেফোঁটাও ছিলো না।
যুনুয়াশ তার সৈন্য নিয়ে নাজরানে চলে আসলো এবং তাদের ইহুদী ধর্ম গ্রহনের জন্য আহ্বান জানালো। এবং সকল কে ভয় দেখালো যে নচেৎ সকল কে হত্যা করা হবে। নাজারান বাসী কঠোর ঈমানি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হল এবং দ্বীনের পথে অটল থাকল। যার ফলে যুনুয়াশ একটি দীর্ঘ পরিখা খনন করলেন এবং তাতে আগুন প্রজ্বলিত করলেন। এর পর নাজারান বাসীদের সেই পরিখায় ফেলে দিলেন এবং অবশিষ্টদের তরবারীদিয়ে হত্যা করলেন।
এই যুনুয়াশের নির্যাতনেরর বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ পাক রাসূল সাঃ এর উপর সূরা বুরুজের ৪ থেকে ৮ নাম্বার আয়াত নাজিল করেন যা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।
দাওস যু-সালাবান নামক সাবা গোত্রের এক ব্যাক্তি যুনুয়াশের গণহত্যা থেকে কোনমতে পালিয়ে রোম সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হয় এবং সাহায্য প্রার্থনা করে। সে যুনুয়াশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সামরিক সাহায্য চায় ও তার নির্মম যুলুমের বর্ণনা করে। উত্তরে রোম সম্রাট বলেন যে “তোমার দেশ আমার দেশ হতে বহু দূরে অবস্থিত। তাই আমার পক্ষে সাহায্য দেয়া সম্ভব নয়।“ তবে তিনি আবিসিনিয়ার রাজা নাজাশিকে চিঠি লিখে পাঠান যে “দাওস কে সাহায্য করো এবং তার কওমের উপর যে যুলুম নির্যাতন করা হয়েছে তার প্রতিশোধ নাও”।
দাওস রোম সম্রাটের চিঠি নিয়ে হাবশিদের বাদশা নাজাশির দরবার উপস্থিত হয়। হাবশিরা ছিলো খ্রিষ্টিয় ধর্মের অনুসারী এবং তা আসল ঈসায়ী নবুওয়াতের বিকৃত রূপ। পারতপক্ষে এরা ছিলো মুশরিক।
রোম সম্রাটের চিঠি পেয়ে নাজাশী ৭০ হাজার আবিসিনিয়কে দাওসের সাথে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করেন এবং আরিয়াত নামের একজন কে সেনাপতি নিযুক্ত করে দেয়। এই বিশাল সৈন্য বাহিনীর একজন অধস্তন সেনাপতি ছিলো আবরাহা আশরাম। আশরাম শব্দের অর্থ “নাক কাটা” ।
আবিসিনিয়রা সমুদ্র পথে ইয়েমেনে এসে পৌঁছুলে যুনুয়াশ তার সেনাদের নিয়ে বাধা দিতে এগিয়ে এলো এবং তুমুল যুদ্ধে যুনুয়াশ পরাজিত হলো। যুনুয়াশ যখন দেখল যে আবিসিনিয়দের সাথে পেরে উঠা সম্ভব নয়, সে গোপনে তার নিজেদের সৈন্যদের সাথে চুক্তি করল এবং সাহায্যের অঙ্গিকার নিলো। সে বিপুল পরিমাণ উপহার নিয়ে আরিয়াতের কাছে উপস্থিত হয়ে তার জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তা চেয়ে নিলো। আরিয়াত এতে রাজি হলো এবং তার সেনাদের নিয়ে ইয়েমেনে প্রবেশ করে সেখানকার সিংহাসন আরোহণ করে।
এদিকে যুনুয়াশ তার সাথীদের নিয়ে গোপনে আবিসিনিয়দের হত্যা করতে লাগলো। অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়ার পরে নাজাশী পুনরায় ইয়েমেনে সৈন্য পাঠালেন, যুনুয়াশ কে হত্যা, এক তৃতীয়াংশ ইয়েমেন বাসীদের ধংস করতে এবং নারী ও শিশু আটক করার নির্দেশ দিলেন। আবরাহা এ নির্দেশ পালন করে।
এরপর আরিয়াতের শাসন বহাল থাকে কিন্তু আবরাহা তার অনুগত হাবশিদের নিয়ে কোন্দল শুরু করে, ফলে আবিসিনিয় সেনাবাহিনী দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল আবরাহার দলে ভিড়ে যায় ও অপরদল আরিয়াতের অনুগত থাকে। একসময় উভয় বাহিনী নিজেদের মাঝে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হলে আবরাহা আরিয়াতের কাছে এই মর্মে প্রস্থাব দেয় যে “দুই বাহিনীর লরাইয়ের পরিনাম ভালো হবে না, বরং উভয় বাহিনী সমূলে ধ্বংস হবে। তার চেয়ে আমরা দুইজন সম্মুখ সমরে লিপ্ত হই। যে জিতবে তার অধীনে উভয় বাহিনী ঐক্য বদ্ধ হবে” । আরিয়াত এতে রাজী হয়ে যায়।
আবরাহা ছিলো বেঁটে, গোঁড়া ক্রিষ্টান ও মোটা। আরিয়াত ছিলো লম্বা, সুদর্শন ও সুঠাম দেহী। যুদ্ধের দিন আবরাহা তার পিছে আরওয়াদাহ নামে এক কৃতদাস রাখল পেছন থেকে আক্রমণের জন্য। আরিয়াত তার হাতের বর্শা দিয়ে আবরাহা কে আক্রমণ করলে মাথায় না লেগে তা লাগে কপালে, এতে আবরাহার নাক ও ভ্রু কেটে যায় এবং ডান চোখ আহত হয়। কিন্তু সাথে সাথেই আরওয়াদাহ পেছন থেকে আরিয়াত কে আক্রমণ করে হত্যা করে এবং অসৎ উপায়ে বিজয়ী হয়।
এরপর আরিয়াতের অনুগত বাহিনী আবরাহার দলে ভিড়ে যায় এবং আবরাহা ইয়েমেনের শাসক হিসেবে তার শাসন কাজ চালাতে থাকে। এবং এভাবেই লাঞ্ছিত দুষ্ট আবরাহার উত্থান ঘটে।